১।
পাথুরি লাল মাটির পাহাড়ি এলাকায় চারিদিকে তুলা, আঁখ, আর কিছু
কাসাভা সহ অন্যান্য ফসলের জমি এবং নানা আকারের, নানা ধরনের
ছোট বড় গাছপালা বেষ্টিত হালকা জনবসতি পূর্ণ একটি গ্রাম। গ্রামের নাম আরযো। গ্রামের
প্রতিটা বাড়িতেই কলার ঝোপ, কয়েকটা পেঁপে গাছ সহ দুই একটা আম, কাঁঠাল,
কমলা কিংবা শ্যরন ফলের গাছ দেখা
যায়। সৌখিন কারো বাড়ির পাশে চেরি এবং ডুমুরের গাছও
আছে, এমনকি কারো বাড়িতে দুই একটা তেঁতুল গাছও দেখা যায়। বাড়ির আশেপাশে
মিষ্টি কুমড়া, কাঁচা মরিচ, টমাটো, সাদা গোল
বেগুন, ফণী মনসার ঝোপ দেখা যায়। বেশ সুন্দর গ্রাম। অধিবাসীরা অধিকাংশই
অবস্থাপন্ন। কৃষি কাজই এদের প্রধান পেশা। নিজেদের উৎপাদিত পণ্য গাধা কিংবা মহিষের
গাড়িতে করে দূরে নিকেমতা নামের ছোট শহরে নিয়ে বিক্রি করে এদের জীবন ভালই চলে যায়। মনে
সুখ শান্তির অভাব নেই। প্রায়ই পূর্ণিমা রাতে গানের আসর বসে সেখানে নাচ গান পান সবই
হয়।
গলায় সিংহের দাঁতের মালা এবং ঈগল ও বাজ পাখির
পালকের মুকুট মাথায় শক্ত চোয়াল আর শক্ত কঠিন পেশির শক্তিশালী যে পুরুষটিকে দেখা
যায় সেই ওবি এই গ্রামের মোড়ল বা লিয়ের। গলায় সিংহের দাঁতের মালা পড়া এদের গোত্রের
মান মর্যাদা এবং শক্তি ও ক্ষমতার প্রতীক। যার মালায় যত বেশি দাঁত থাকে সে তত
শক্তিশালী এবং ক্ষমতাবান লিয়ের। এই দেখেই বোঝা যায় সে কতগুলি সিংহ মেরেছে। গ্রাম
থেকে একটু দূরে দক্ষিণ দিকে ছোট দেদেসা নদীর পরেই বিশাল দিগেত বোস বা ঘন জঙ্গল।
নদীর পার দিয়ে জঙ্গলের আকৃতি বেশ ঘন, উঁচু গাছগাছালিতে ভরা।
সাথে আছে শন, নল খাগরা, হোগলা এবং আখের মত বেশ বড় বুনো ঘাস প্রায় মানুষ
সমান উঁচু এবং অন্যান্য ঝোপঝাড়। তবে নদীর কিনার থেকে কিছু দূরে রুক্ষ পাহাড়ি
এলাকা। কাটা বাবলা সহ অন্যান্য বেশ বড় বড় গাছপালা মাঝে মাঝে বনের শোভা বৃদ্ধি
করেছে। পাহাড়ের ফাকে ফাকে নিচু অঞ্চলে প্রায় সারা বছরই বৃষ্টির পানি জমে থাকে। এক
দুই মাইল জুরে প্রায়ই এমন জলা ভূমি রয়েছে। এই জলাভূমির চারিদিকেও ওইরকম ঘাস।
আশেপাশে নানা জাতের পাখপাখালির কিচিরমিচিরে দিনরাত এই সব লেক এলাকা মুখর থাকে। বনে বিশেষ করে সিংহ এবং হাতির সংখ্যাই বেশি, কিছু বুনো
মহিষও আছে আর এর সাথে চিতা, নেকরে, জেব্রা, হরিণ এগুলি
তো আছেই। জঙ্গলের ভিতরে এ রকম অনেক ছোট খাট লেক থাকলেও এখানকার বাসিন্দারা মাঝে
মাঝেই সম্ভবত রুচি বদলের জন্য দল বেধে পাশের নদীতে পানি পান করতে কিংবা গোসলের
জন্য আসলেও সাধারণত নদী পার হয়ে এপারে আসার ইচ্ছা করে না। তবে কখনও কখনও যে নদী
সাতরে গ্রামে আসেই না সে কথা বলার উপায় নেই। এইতো সেবার নদীর পাড়ে আখ ক্ষেতে কাজ
করার সময় নুবিয়াকে ধরে নিয়ে গেল। সাথে জিঙ্গো, চিকা, মিন্ডি আর
দাগুর স্ত্রী এবং আরও কয়েকজন ছিল কিন্তু কিছুতেই তারা ওই বনের রাজা লিউ বা
সিংহটাকে কাবু করতে পারেনি। এছাড়াও মাঝে মাঝে গ্রামের মেঠো পথে বা কারো বাড়ির
উঠানে সিংহের পায়ের ছাপ দেখা যায়।
বিশাল এলাকা নিয়ে মাইলের পর মাইল জুরে এই
বনভূমি। আরযো গ্রাম থেকে পুবে বা দক্ষিণে কোথাও যেতে হলে এই বনের মধ্যে দিয়ে গেলে
পথ অনেক কমে যায়। মাত্র দুই মাইল পথ হেটেই ওপাশের কোসি গ্রামে যেতে পারে। তবে
উত্তরে বা দক্ষিণে বনের প্রশস্ততা অনেক, প্রায় দশ থেকে বিশ
মাইলের মত। শুধু ওই জায়গাটা সরু। বনের পশু এবং গ্রামবাসীরা যাতায়াত করতে করতে মেঠো
পথের মত হয়ে গেছে। কিন্তু একা একা এই পথ কোন অবস্থাতেই নিরাপদ নয়। দল বেধে যেতে
হলে সবাই এই পথেই যায়। কোসি গ্রাম থেকেও যখন
লোকজনেরা কোন কাজে এদিকে আসে তখনও তারা এই ভাবেই দল বেধে আসে। সাথে থাকে
নানা রকম অস্ত্র এবং মশাল। দমন করা যাবে না এমন জীবের সামনে পরলে মশাল থেকে আগুন
নিয়ে নরম ঘাসের গোলা বাধা তীর ছুড়ে দেয় পশুর দিকে। আগুন দেখে ওরা দূর থেকেই বুঝতে
পেরে ভয়ে আর কাছে আসে না। বুনো পথে চলাচলের জন্য এদের জানা আছে প্রচলিত নানা
মন্ত্র। সাথে যে মোড়ল থাকে সেই প্রধানত মন্ত্র আওড়ায় এবং সঙ্গীরা তার সাথে সুর
মিলিয়ে পথ চলে। বনের ভাষা এরা বুঝতে পারে। কোথায় কোন শব্দ হলে সে কিসের শব্দ তা
এরা ভাল করেই জানে। সবচেয়ে ভয় হলো সিংহ আর চিতা নিয়ে। এরা বড়ই ভয়ংকর! চিতা গাছে
উঠতে পারে এবং নিঃশব্দে চলাফেরা করে বলে আশেপাশে তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না
বললেই চলে। দৌড়ে গিয়ে যত বড় গাছেই ওঠা হোক না কেন চিতা ঠিক পিছনে পিছনে উঠে পড়ে।
সিংহ গাছে না উঠলেও নিচে দাঁড়িয়ে থাকে এবং তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন ব্যাপার।
আমাবস্যা পূর্ণিমা রাতে কিংবা মেঘলা দিনে বিচিত্র সব হাঁক ডাকের শব্দ পাওয়া যায়।
তার কোনটা প্রিয়কে কাছে আহবান করার ডাক আবার কোনটা ক্ষুধার ডাক কিংবা কোনটা শত্রুর
উপর আক্রোশ তা ডাক শুনেই বোঝা যায়। সন্তান হারা মায়ের করুণ কান্নার সুরও বড়ই বিষাদ নিয়ে বাতাসে ভেসে আসে। গ্রাম থেকে
নদী পার হয়ে বনে যাবার জন্য ওবির বাড়ির কাছে নদীর ঘাটে একটা আস্ত গাছের গুড়ি দিয়ে বানান ভেলার মত বাঁধা
থাকে।
পশ্চিমে গোরে এবং বেদেলে গ্রাম, উত্তরে
নিকেমতা, মান্ডি এবং আমতো গ্রামের সাথে মোটামুটি ভাল ভাব আছে। পূর্ব দিকে বেশ
অনেকটা দূরে সেনেন, মুতুলু এবং বিলা গ্রাম। পাহাড় জঙ্গল পেরিয়ে
ওদিকে খুব একটা যাতায়াত নেই বললেই চলে। আর ওই জঙ্গল পেরিয়ে আরও বেশ দূরে দক্ষিণে
আটনাগো গ্রাম। অনেকদিন ধরে কোন দাঙ্গা হাঙ্গামা বা অপরোর হয়নি। অনেকদিন আগে ওবির
দাদা জীবিত থাকতে যখন ওবি ছোট ছিল তখন দেখেছিল মান্ডি গ্রামের সাথে কি ভয়ংকর
দাঙ্গা হয়েছিল। মান্ডিবাসিদের সাথে আমতো গ্রামও যোগ দিয়েছিল তবে পার্শ্ববর্তী
পশ্চিমের গোরে এবং বেদেলে গ্রাম ওদের পক্ষে এসেছিল। কত মানুষ মরেছিল সে যুদ্ধে তা
গুনে দেখা হয়নি। তবে এটুক মনে আছে অনেকেই মরে গিয়েছিল এবং তাদের এনে নদীর কিনারে
গর্ত করে মাটি চাপা দিয়েছিল। ও পক্ষের কতজন মরেছিল তা জানা যায়নি। নানা রকম নানা
আকারের সিফ, জাকিতকা (তরবারি, বর্শা), মহিষের শিং
বা গিসকা দিয়ে বানান নানা রকমের অস্ত্র এবং আগুনের গোলা আর বিষ মাখা তীর ধনুক কি
ভাবে ব্যবহার করতে হয় তখনই ওবি দেখেছিল। তার দাদা তাকে শিখিয়েছিল।
২।
ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা থেকে ২৫০
কিমি পশ্চিমে এই আরযো গ্রাম। গ্রাম ঘেঁসে আদ্দিস আবাবা থেকে আসা কাঁচা রাস্তা
নিকেমতা এবং গেতেমা হয়ে বেদেলের দিকে চলে গেছে। গ্রামের একেবারে দক্ষিণে দেদেসা
নদীর খুব কাছেই ওবির বাড়ি। বুনো ঘাসের ডাটা এবং শণ দিয়ে ছাউনি দেয়া গোলাকৃতির
মাটির দেয়ালের বেশ কয়েকটা ঘর। আরামে থাকার জন্য ঘরের চালের নিচে ঘাসের পুরু আস্তর
দিয়ে সুন্দর করে ছেয়ে দেয়া। মাটির মেঝে সুন্দর করে লেপা মোছা। এই এলাকায় ঘরের দেয়াল
ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বানায়। শীত গ্রীষ্ম থেকে রক্ষা পাবার জন্য কোথাও মাটির দেয়ালের
ভিতরে ঘাসের আস্তর দিয়ে দেয় আবার কোথাও কাঁচা মাটির ইট বানিয়ে সেই ইট গেঁথে দেয়াল
বানায়। এমনি এক ঘরে ওবি এবং তার স্ত্রী রামলা থাকে আর এক ঘরে থাকে ছেলে আবেল। অন্য
ঘরগুলিতে ফসল বা সংসারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় মালামাল থাকে। আবেল এখন বড় হয়েছে।
বিয়ে করে বৌয়ের কাছে চলে যাবে কিন্তু আবেল তার মনোমত পাত্রী খুঁজে পাচ্ছে না। নিয়ম
অনুযায়ী নিজেদের গোত্রের মধ্যেই এদের বিয়েশাদী হয় তবে যদি ভিন্ন কোন গোত্রের ছেলে
বা মেয়ের কাউকে পছন্দ হয় তাহলে সে ছেলে ওই মেয়ের বাবা মাকে প্রস্তাব পাঠাতে পারে
এবং কেরেল বা মিনার (প্রেমিক প্রেমিকা) এর বাবা মা এবং মোড়ল যদি সম্মতি দেয় তাহলে
সে বিয়ে হতে পারে। সাধারণত মোড়ল খুঁজে দেখে ওই গোত্রের বা গ্রামের সাথে এদের
সম্পর্কটা কেমন। যদি বিগত দুই চার পুরুষের মধ্যে কোন দাঙ্গা হাঙ্গামার ইতিহাস না
থাকে তাহলে মোড়ল আপত্তি করে না।
আবেল গতবছর তুলা বীজ বা কাটোনসাদ আনার জন্য
গাধার পিঠে বসে বনের সিংহ বা অন্যান্য জীব জন্তুদের এড়িয়ে ঘুরা পথে বেদেল হয়ে
আটনাগো গিয়েছিল। ওখানকার তুলা বীজ বেশ ভাল তাই বছরে অন্তত একবার আরযো গ্রামের
বাসিন্দারা তুলা বীজ কেনার জন্য ওখানে যায়।
এই এলাকা আবার একটু ভিন্ন রকম। এখানে বুন্না বা কফি চাষ হয় কিন্তু আখের চাষ খুবই
কম। বাড়ির ঘরগুলি ঢেউ টিনের ছাউনি দেয়া, মাটির দেয়াল এবং
কাঠের দরজা জানালা, মাটির মেঝে। এখানকার গৃহস্থের অবস্থা আরযো
গ্রামের চেয়ে ভাল। এখানে বুন্না চাষ হয়। বাইরে বুন্নার দাম বেশি, আখ দিয়ে
এলাকার ঘরে ঘরে কালা কাটি বা বিয়ার (হালকা এলকোহলিক পানীয়) তৈরি হয়।
আবেল আটনাগো গ্রামে বুজিবার বাড়িতে গিয়ে যখন
পৌঁছল তখন বেলা পড়ে এসেছিল। গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হয়নি বলে দিনটা ছিল বেশ গরম। ওই
এলাকার রীতি অনুযায়ী বাড়ির যুবতী বড় মেয়েকে অতিথি আপ্যায়ন করতে হয়। আবেল এসে সামনে
এক যুবতী মেয়েকে দেখে জানতে চাইল
বুজিবা কোথায়?
বাবা বাড়ি নেই।
তুমি কোথা থেকে এসেছ, কি
জন্যে তাকে খুঁজছ?
আমি আরযো থেকে এসেছি, তুলা
বীজ নিতে, আমার নাম আবেল।
ও আচ্ছা
বলে বুজিবার মেয়ে মালাইকা জল চৌকির মত একটা
টুল পেতে দিল।
তুমি বস আমি আসছি। আবেলকে দেখেই মালাইকার
মনে হলো এই সেই পুরুষ যাকে সে এতদিন ধরে খুঁজছে, তাদের
এই গায়ে এমন সুপুরুষ আর নেই। যেমন মেদহীন কঠিন চেহারা, তেমনি
পেশী, মাথায় ঘন কাল কোঁকড়ান চুল, কুচকুচে
কাল গায়ের রঙ দেখতে একেবারে কাটা বাবলার গুড়ির মত। সন্ধ্যা বেলায় এসেছে েখন আবার
অত দূরে যাবে কি করে? অতিথিকে আজ এখানে রাতে থাকতে হবে কাল সকালে যাবে এবং এই ব্যবস্থাই করতে হবে।
মালাইকা মনে মনে এমন একটা বুদ্ধি এঁটে ফেলেছে। একটু পরে এক হাতে বুন্নার পেয়ালা আর
আর এক হাতে পাতার তৈরি পাখা নিয়ে এলো। মালাইকার মা কালিশা এসে দেখে গেল কে কি
জন্যে এসেছে। মালাইকার পরনে জংলা ছাপার পেটিকোট আর গায়েও তেমনি ব্লাউজ কিন্তু এই
সামান্য ব্লাউজে টগবগে যৌবন কিছুতেই বাধ মানতে চাইছে না। গলায় এবং হাতে
নানা রকমের মালা। মালাইকার চেহারার দিকে তাকিয়ে আবেল থেমে গেল। সাক্ষাত কাল বন পরী।
গোলগাল ধরনের ঝিম কাল চেহারার মধ্যে সাদা চোখ আর সাদা দাঁত যেন মুক্তার মত চিকচিক
করছে। পুরু ঠোট। স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী মাথার চুলে অনেকগুলি চিকন বেণী দিয়ে পিছনে
খোপা বাধা, তাতে আবার ছোট ছোট শামুকের মালা জড়ান। এমন রূপ আবেল জীবনে দেখেনি। গলার মালায় একটা
কুমিরের দাঁত আছে। এর মানে হলো সে কোন শক্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। রূপের সাথে
শক্তি! অবাক হবার মত কথা। এই মেয়ে কি কারো বাগদত্তা? এ কাকে
বিয়ে করে সংসার করবে? কি ভাবে সে জানবে এই কথা? কি করে
তার মনের কথা একে জানাবে? মুহূর্তের মধ্যেই
আবেল ঘামতে শুরু করল। সারাদিনের পথের ক্লান্তিতেও আবেল এতটা ঘামেনি। মালাইকা লক্ষ
করে বলল
নাও আতো, বুন্না
(কফি) খেয়ে জুরিয়ে নাও তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে
আবেলের হাতে বুন্নার মাটির পেয়ালা ধরিয়ে
দিয়ে পাতার পাখা দিয়ে বাতাস করছে। মালাইকাও এমন শক্ত সুঠাম পেশীবহুল পুরুষোচিত
চেহারা দেখে সেই থেকেই বারবার দেখছে। এমন পেশী যার তার সাথে নির্ভাবনায় এক সাথে এক
চালের নিচে দুইজনে মিলে জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। সন্তানেরাও এমনি হবে। আলাপ করতে
হবে। একে হাতছাড়া করা যাবে না। যেমন করেই হোক আটকাতে হবে।
কেমন আছ? পথে কোন
অসুবিধা হয়েছে?
না তেমন কোন অসুবিধা হয়নি।
তুমি কি শুধু বীজ নিতেই এসেছ? এর আগে
তো তোমাকে কখনও দেখিনি!
আগে বাবাই আসত। হ্যাঁ, বাড়ি
থেকে এজন্যেই বেড়িয়েছিলাম কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আরও কিছু নিতে হবে!
আর কি নিবে? আমাদের
এখানে শুধু তুলা বীজ ছাড়া আর কিছু নেই!
আবেল ভাবল কেন সুন্দরী তুমি আছ না? তোমার
জন্যেই আমি এসেছি।
আচ্ছা ওইজিরিতি, তোমার নাম
কি?
আমার নাম মালাইকা।
মালাইকা!
আবেল জানে মালাইকা মানে পরী। তাহলে সে ঠিকই
ভেবেছে! তার ভাবনায় কোন ভুল নেই!
বাহ! সুন্দর নাম!
একটু ভেবে মালাইকার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা
করে বলল
তুমি কি কাওকে কথা দিয়েছ?
এই বয়সের ছেলে মেয়েরা (আতো এবং ওইজিরিতিরা)
জানে এই কথা দেয়ার মানে কি।
মালাইকা একটু ভেবে বলল
না
তাহলে আমি তোমাকে প্রস্তাব জানালাম। অযোগ্য
মনে না করলে আমার কথাটা ভেবে দেখবে।
প্রস্তাবের কথা শুনেই মালাইকার দেহে মনে
প্রাণে একটা আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। আহ! কি প্রশান্তি! আমিতো এই চাইছি।
আবেল কথাটা বলেই তার বংশের কিছু বীরত্ব
গাঁথা শোনাল। আর এই যে দেখ আমার গলায়ও কুমিরের দাঁতের মালা।
এবার বল বুজিরা কখন আসবে?
বাবার আসতে হবে না, মা
তোমাকে বীজ মেপে দিবে কিন্তু সে তো কাল দিবে!
কেন কাল কেন?
সে কি! বুঝতে পারছ না? রাত হয়ে
আসছে এই অন্ধকার রাতে অত দূরে যাবে কি করে? রাতে
এখানে থাকবে কাল সকালে বীজ নিয়ে যাবে।
আর আমি যে বললাম সে ব্যাপারে তোমার উত্তর
কখন জানাবে?
এখনই
তাহলে বল
দেখ তুমি তো ভিন গায়ের ভিন গোত্রের আতো
এই পর্যন্ত বলে একটু থামল।
হ্যাঁ বল তাতে কি হলো?
তুমি বাবা মার কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসতে
পারবে?
নিশ্চয় পারব
তাহলে এসো।
আবেল মনে মনে ভীষণ খুশি হলো, এতক্ষণ
যে ভয়ে ছিল তার কিছুটা দূর হলো। আবার বলছে রাতে এখানে থেকে কাল যেতে। ভালই হবে আরও
কিছু বেশি সময় পাবো ওকে দেখতে। রাতের খাবার সময় কি আর কিছু কথা হবে না? শুধু
শুধু রাতে থাকার কথা নিষেধ করবে কেন? তবুও একটু লজ্জার
ব্যাপার না! থাকতে বলবে আর ওমনিই থাকতে হবে? সে বাড়ি
ফিরে যাবে এমন চিন্তা করেই এসেছে।
আবেল বুন্না শেষ করে খালি পেয়ালাটা মালাইকার
হাতে দিতে দিতে বলল
না না থাকতে হবে না, আমি
আমার গাধা নিয়ে এসেছি ওর সাথেই চলে যেতে পারব।
তা বললেই কি হয়? অন্ধকার
রাতে এই পাহাড়ি পথে একা একা এত দূরে যাবার এমন কি দরকার? তোমার
কে আছে? দেখেইতো মনে হয় তোমার কোন প্রিয়তমা নেই!
না, কে
থাকবে? কেউ থাকলে কি আমার কথা ভেবে দেখার কথা বলতাম তোমাকে? তোমাকে
আমার ভীষণ ভাল লেগেছে মালাইকা। মনে হচ্ছে তোমাকে সাথে পেলে আমি জীবনে খুব সুখী হব।
তাহলে আর যেতে চাইছ কেন? থাক, আজ আমি
বুনো মহিষের মাংস রান্না করছি।
তুমি যেভাবে বলছ তাতে আজ আর যেতে পারছি না, এমনিতেও
তোমাদের এখানে খুব ভাল লাগছে। বুন্না ক্ষেতগুলা বেশ সুন্দর দেখতে! তবে তুমিই
সবচেয়ে বেশি সুন্দর। এখন মনে হচ্ছে আজ এখানে না আসলে মস্ত ভুল হতো আমি তোমাকে পেতাম
না।
কি যে বল তুমি! তোমরা বুন্নার চাষ কর না?
না আমাদের ওদিকে কেউ করে না।
মালাইকা, তুমি
খুবই সুন্দর!
তুমিও
বলেই মালাইকা লজ্জা পেয়ে খালি পেয়ালা নিয়ে
আড়ালে চলে গেল।
আবেল নিজে নিজেই মালাইকার রেখে যাওয়া পাখা
দিয়ে বাতাস নিচ্ছে।
৩।
সন্ধ্যার পরেই মালাইকার বাবা বুজিবা বাড়িতে
এসে আবেলকে দেখতে পেয়ে অভ্যাস মত কোমরে বেল্টের সাথে গোজা ছুরির বাটে হাত রেখে
জিজ্ঞেস করল
তুমি?
আমি আরযো থেকে এসেছি।
আচ্ছা, বাইরের
ওই গাধাটা কি তোমার?
হ্যাঁ
ওকে কিছু খেতে দিয়েছ? কত দূর
থেকে এসেছে!
না, আমি
তুলা বীজ নিতে এসেছি তাই ভাবলাম বীজ নিয়েই চলে যাব
ও,
তোমাদের লিয়ের ওবি না?
হ্যাঁ, আমার
বাবা ওবি।
কি বললে, ওবি
তোমার বাবা!
হ্যাঁ
আরে! বল কি? তুমি
ওবির ছেলে? ওবিতো আমার বন্ধু! সেই যে গতবার এসেছিল তারপরে আর কোন
খোজ খবর নেই
তাই নাকি? হ্যাঁ
তাই হবে কারণ আমি এখানে আসতে চাইছিলাম না বলে বাবা বলেছিল তুমি যাও দেখবে বুজিরা
যখন তোমাকে দেখবে তখন তোমার কোন অসুবিধা হবে না।
ও! তাই নাকি!
হ্যাঁ
আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক
কথাই বলেছে তোমার বাবা। তুমি যখন আমার বাড়িতে এসেছ তাহলে বাপু আজ আর তোমার যাওয়া
হবে না। রাতটা থাক। এত দূরের পাহাড়ি পথ একা একা যাবে কি করে? রাতে এক
সাথে খাওয়া দাওয়া করব আর কাটি কালা (বিয়ার) খাব আমাদের বাড়িতে তৈরি কাটি কালা। আমি
একটু দেখি তোমার গাধাকে কিছু খাবার দেয়া আর বিশ্রামের ব্যবস্থা করছি।
সহস্র মাইল বেগে মালাইকার নিমন্ত্রণের কথা
ভেবে মনে ভীষণ আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল কিন্তু মুখের ভাবে প্রকাশ হতে দিল না। মনে মনে
বলল এই নিমন্ত্রণ আমি আগেই পেয়েছি বুজিবা!
মালাইকা বুন্না দিয়েছে? বুন্না
খেয়েছ?
হ্যাঁ বুন্না খেয়েছি।
বুজিবা ওকে বসতে বলে উঠে বাড়ির বাইরে চলে
গেল।
রাতে বেগুন মরিচের ঝোল, বুনো
মহিষের ঝলসান মাংস আর অতিথির জন্যে বানান কাসাভা এবং ভুট্টার মেশান আটা দিয়ে প্যান
কেকের মত পুরু রুটি বা ইঙ্গেরা দিয়ে সবাই মিলে বাড়ির উঠানে আগুন জ্বেলে গোল হয়ে
বসে দারুণ খাবার হলো। সাথে ছিল মালাইকার মায়ের বানান কাটি কালা। আখের রস দিয়ে
বানায়। এই জিনিস আবেলের মাও বানায় তবে আজকারটাই বেশি মজার বলে মনে হলো। খাবার ফাকে
ফাকে টুকি টাকি কথাবার্তা। মালাইকা মাংস ঝলসিয়েছে বলে বারবার জিজ্ঞেস করছিল কেমন
হয়েছে? আবেলও বলছিল বেশ ভাল হয়েছে। অনেক খেয়েছি। আবেল কাটি
কালার কথাও বলে ফেলল। আমার মায়ের চেয়ে খুব ভাল হয়েছে এটা। মালাইকার মা তার স্বামীর
বন্ধুর ছেলে জেনে সেও বেশ আদর আপ্যায়ন করল। খাবার শেষ হলে উঠানে বসে নল দিয়ে পোড়ান
তামাকের ধুয়া সেবন হলো। এবার শোবার পালা।
বুজিবা মালাইকাকে বলে দিল ওকে ওই ঘরটায় শোবার ব্যবস্থা করে দিও।
আমার সাথে এসো বলে মালাইকা আগে আগে গেল।
আবেল মালাইকাকে অনুসরণ করে একটা ঘরে ঢুকল। চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখল সুন্দর ছিমছাম
সাজান ঘর। ভাল্লুকের চর্বি দিয়ে জ্বালান প্রদীপ জ্বলছে। নানা ধরনের নানা ডিজাইনের
তির ধনুক, মহিষের শিং দিয়ে বানান নানা কারুকাজ করা বর্শা, সিংহ, ভাল্লুকের
চামড়াসহ বিভিন্ন জিনিসে সাজান। মাচায় বিছানা পাতা।
দেখ আতো তোমার আর কি লাগবে!
না না আর কি লাগবে? আচ্ছা
তুমি আমাকে শুধু আতো বলে ডাকছ কেন?
তাহলে কি বলে ডাকব?
কেন আমার কি কোন নাম নেই?
আচ্ছা আবেল তুমি আরও একটু কাটি কালা খাবে?
না অনেক খেয়েছি,
একটু তামাক?
না না আর কিছুই লাগবে না, তুমি কি
আমার পাশে এখানে একটু বসবে?
মালাইকা দরজা দিয়ে উকি দিয়ে একটু দেখে এসে
আবেলের পাশে বসল।
বল কি বলবে
না কিছু বলব না শুধু তোমাকে একটু পাশে পাবার
জন্য বসতে বলেছি।
আস্তে আস্তে মালাইকার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে
বলল
তুমি আমার জন্য একটু অপেক্ষা কর দেখবে আমার বাবাকে দিয়ে আমি ঠিক
প্রস্তাব পাঠাব।
তাড়াতাড়ি করবে। আমাদের এখানকার চিমাকে দেখছি
আমার দিকে কেমন করে যেন তাকায়। ওকে আমি দুই চক্ষে দেখতে পারি না, শুধু
কাটি কালা আর তেলা খায় আর তামাক টানে। আজ পর্যন্ত কোন মর্দামি দেখাতে পারেনি, একটা
বিড়ালও মারতে পারেনি।
হাত আরও জোরে চেপে ধরে, না না
মালাইকা এ আমি কিছুতেই হতে দিব না, আমি চেষ্টা করব যত
তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রস্তাব পাঠাতে।
তাহলে আমি যাই তুমি ঘুমিয়ে পর, সকালে
আবার দেখা হবে।
আচ্ছা।
৪।
সকালে ঘুম ভাঙল ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই।
ঘরের বাইরে এসে দেখে রান্নার জায়গায় মালাইকা কি যেন রাঁধছে। আবেল একটু এগিয়ে গেল।
কি রাঁধছ?
কাসাভার জাউ, আর কি
খাবে তুমি বল
যা আছে তাই হলেই চলবে তোমাকে এত ব্যস্ত হতে
হবে না।
বলেই বাইরে এসে খোয়ারে যেখানে এ বাড়ির গরু
গাধা থাকে সেখানে গিয়ে ওর গাধা বের করে বাইরে এনে বেধে রেখে পাশের চাই থেকে একটু
পানি এনে খেতে দিয়ে আবার বাড়িতে ফিরে আসল।
একে একে সবাই উঠে পরল। বুজিবা সকালে উঠে
কোথায় যেন গিয়েছিল সেও ফিরে আসল।
কি খবর আবেল কি করছ।
না কিছু করছি না, আমাকে
বীজগুলা দিয়ে দিলে আমি এখনই রওয়ানা হতে পারি।
যাবে যাবে অত তারা কিসের? কিছু
খেয়ে যাবে না? সারা দিনের পথ! কিছু খেয়ে না গেলে তোমার বাবা আমাকে কি
বলবে জান?
কাসাভার জাউ, তিতির
পাখির ডিম সেদ্ধ আর রাতের মহিষের মাংস দিয়ে নাশতা খেয়ে বীজ নিয়ে আবেল তার গাধা
নিয়ে আরযোর পথে রওয়ানা হলো। যাবার আগে এক ফাকে মালাইকাকে বলল, তুমি
ভেবো না আমি খুব শিগগীরই আবার আসছি। এখন তোমাকে না দেখে আমি খুব কষ্টে থাকব।
মালাইকা বলেছিল থাক এত কষ্ট করে এত দূরে আসতে হবে না। মালাইকার মাও বলল আবার এসো।
আবেল গাধার রশি ধরে আগে আগে হাঁটছে আর পিছনে মালাইকা তার পথের দিকে তাকিয়ে আছে।
যতক্ষণ সামনের পাহাড়ের আড়াল না হলো ততক্ষণ তাকিয়েই রইল। ফিরে এসো আতো তুমি আবার
এসো।
৫।
বাড়ি এসে পৌঁছল সেদিনের মত সন্ধ্যা হবার
একটু আগে। পথে বাবা ওবির সাথে দেখা। বাবা ওকে দেখেই মিট মিট করে হাসছিল।
তুমি আমাকে বলনি কেন যে বুজিবা তোমার বন্ধু?
আমি তোর সাথে একটু মজা করেছিলাম। ওখানে কেমন
কাটালি? বুজিবা আমার কথা জিজ্ঞেস করেনি? বুজিবার
মেয়েকে দেখেছিস?
বাবার সাথে কথা বলতে বলতে বাড়ি এসে পরল। মা
দেখে তাড়াতাড়ি দৌড়ে কাছে এসে গাধার পিঠ থেকে বীজের থলে নামিয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে
ধরল।
আমার মানিক তুই কতদিন পরে এসেছিস! আমি
অস্থির হয়ে গেছি মানিক।
না মা অস্থির হবার মত কিছু হয়নি ওরা আমাকে
অনেক খাতির যত্ন করেছ মালাইকা খুব ভাল মেয়ে।
মা জিজ্ঞেস করল, মালাইকা আবার কে?
পথের ক্লান্তি ধুয়ে মুছে মা বাবাকে এক সাথে
নিয়ে উঠানে বসে বুজিবার বাড়ির সমস্ত গল্প করল। পরীক্ষামুলক চাষের জন্যে বুজিবা
কিছু বুন্না বীজ উপহার দিয়েছে সেগুলি বের করে দেখাল। মালাইকার সাথে দেখা হওয়া থেকে
শুরু করে ভাল লাগা এবং কথা দেয়া পর্যন্ত সবই বলল। মালাইকার কথা শুনে বাবা খুব খুশি
হলো মনে হলো। গতবার যখন বাবা ওখানে গিয়েছিল তখন মালাইকাকে দেখে তার মনেও এই ধারনা
হয়েছিল বলেই এবার সে নিজে না গিয়ে ছেলেকে পাঠিয়েছে। সে নিজের চোখেই দেখে আসুক।
ও, বুজিবা বুন্না বীজ
দিয়েছে! তাহলে এক কাজ করি এবার আমাদের ওই নদীর পারে যে জমিগুলা আছে ওখানে বুন্না
বুনে দেখি কেমন হয়। কি বলিস?
আমি আর কি বলব মাকে জিজ্ঞেস করে দেখ কি বলে
হ্যাঁ ঠিক বলেছিস, আচ্ছা রামলা তুমিই বল এই বীজগুলা
কোথায় চাষ করা যায়?
কেমন জমির প্রয়োজন সে কি আর আমি জানি আমাদের
এই অঞ্চলে বুন্নার চাষ কখনও দেখিনি কাজেই তুমি এক কাজ কর বুজিবাকে নেমন্তন্ন কর, সে এসে
আমাদের জমিগুলা দেখে বলে দিবে কোন জমিতে এর চাষ করবে
বাহ! বেশ ভাল কথা বলেছ
বাবা, তুমি
যদি বল তাহলে আমি আবার গিয়ে বুজিবাকে নেমন্তন্ন করে আসতে পারি
তুই যাবি?
তুমি বললে যেতে পারি
আচ্ছা, ভেবে
দেখি।
৬।
সকালে চিমা বুজিবার পাশের বাড়িতে তার বন্ধু ওর
মতই অকর্মা ইনুর সাথে আড্ডা দেয়ার জন্যে যখন আসছিল তখন আবেলকে মালাইকাদের বাড়ি
থেকে বের হতে দেখে সে তার মত পরিবর্তন করে ইনুর বাড়িতে না গিয়ে মালাইকাদের বাড়িতে
এলো। এসে দেখে মালাইকা বাড়ি থেকে বের হবার পথে বিশাল বাবলা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এই
মাত্র অচেনা যে লোকটা গাধা নিয়ে চলে যাচ্ছে তার পথের দিকে চেয়ে আছে।
কিরে মালাইকা এখানে দাঁড়িয়ে কার পথের দিকে
তাকিয়ে আছিস? ও তোর কে হয়? আগে তো কখনও দেখিনি!
মালাইকা চিমাকে আসতে দেখেছে কিন্তু ও যে ওদের
বাড়িতেই আসছে বুঝতে পারেনি। ওকে ওর সামনে দাড়াতে দেখে একটু ঘাবড়ে গেল। পিছন ঘুরে
বাড়ির ভিতরে যেতে উদ্যত হল কিন্তু চিমার কথায় থেমে গেল।
যেই হোক তাতে তোর কি? তুই কেন
এসেছিস?
ও! তাহলে এই ব্যাপার! দাড়া দেখাচ্ছি আমি কেন
এসেছি!
তুই আবার কি দেখাবি, তোর কি
মুরোদ আছে যে দেখাবি? সারা দিন পরে থাকিস শুধু কালা কাটির কলসি নিয়ে, আর কি পারিস
তুই?
মালাইকা মনে মনে একটু ভয় পেল। যদিও ভয় পাবার
মেয়ে অন্তত মালাইকা নয়। তবুও শুধু শুধু ঝামেলায় জড়াবার কি দরকার? চিমা মোড়লের
ছেলে হলে হবে কি! একেবারে অকর্মার হাড্ডি। গায়ে গতরে একটা বিড়ালের শক্তিও নেই।
মালাইকা ভাবতেও পারেনি চিমা কি করতে এখানে এসেছে।
বুজিবা বাড়ি আছ?
বাবাকে কেন ডাকছিস?
দেখবি বুজিবা আসুক তখনই শুনবি কেন ডাকছি
ভিতর থেকে বুজিবা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল
কে?
এইতো, আমি চিমা
কি ব্যাপার চিমা! তুমি এখানে এই সময়ে?
কেন, আমার কি এখানে আসতে নেই
নাকি?
না তা বলছি না তবে তুমি তো কখনও আস না তাই
বলছিলাম
এখনও তেমন কোন দরকার হয়নি তাই আসা হয় না এবারে
দরকার হলো তাই এলাম, তুমি কি চলে যেতে বলছ?
না, তা বলছি না। বল কি
ব্যাপার
বলব। কথাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই চল ওই ওখানে
একটু বসে বলি
চল
দুই ঘরের মাঝে গাছের ডাল দিয়ে বানান একটা বেঞ্চে
দুই জনে বসল।
বল
আসলে আমি মালাইকাকে বিয়ে করতে চাই এবং এই কথা
বলতেই আজ এখানে এসেছি। ওকে আমার খুব পছন্দ
কিন্তু আমার মনে হয় ও তোমাকে চায় না কাজেই তোমার
এই এক তরফা চাওয়ার কি কোন মূল্য আছে? তাছাড়া তোমার ক্ষমতা
সম্পর্কে এ গ্রামের সবাই জানে
দেখ বুজিবা আমি এত কথায় কান দিতে পারি না। আমার
ওই এক কথা, আমি মালাইকাকে চাই
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি তোমার বাবাকে বল, সে যদি আসে
তাহলে ভেবে দেখব
এতে আবার ভাবার কি আছে? বাবা কি
আলাদা কিছু বলবে, আমি যা চাইব বাবা তাই বলবে
বেশ তুমি তাকে বলেই দেখ
আচ্ছা আমি তাকে নিয়েই আবার আসব।
৭।
সেদিন চিমা চলে যাবার কয়েকদিন পর সকাল বেলা চিমা
আর চিমার বাবা ফোলামি এসে হাজির।
ফোলামিকে দেখেই বুজিবা চমকে উঠল। তাহলে চিমা
ঠিকই তার বাবাকে নিয়ে এসেছে! কিন্তু বুঝতে পারছি না ফোলামি কেমন করে আমার মেয়ের
সাথে ওর এই অকর্মা ছেলের প্রস্তাব নিয়ে আসল? মনের কথা
মনেই চেপে রেখে জিজ্ঞেস করল
কি ব্যাপার লিয়ের তুমি কেন এসেছ?
আসলাম একটা প্রস্তাব নিয়ে, চল আগে একটু
বসি তারপরে বলি। আর শোন একটু তামাক জ্বালাবার ব্যবস্থা কর।
চল বসি, তামাকের
ব্যবস্থাও করছি।
লিয়েরকে দেখে বুজিবার স্ত্রী উঠানের পাশে ঘরের
পিছনের বিশাল তেঁতুল গাছের ছায়ার নিচে পিড়ি পেতে বসার ব্যবস্থা করে দিল। বসতে বলে
তামাকে আগুনের আয়োজন করতে গেল। ওদিকে মালাইকা পাশের ঘরে গিয়ে এদিকে কান পেতে বসে
রইল।
শোন বুজিবা আমি এসেছি তোমার মেয়ের সাথে চিমার
বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে
শুনেই বুজিবা চমকে উঠল। স্বয়ং মোড়ল এসেছে। একে
কিছুতেই বিগড়ানো যাবে না। তাহলে এই গ্রামে বসবাস করা কঠিন হয়ে যাবে। হয়ত আবার একটা
দাঙ্গা হাঙ্গামাও হতে পারে। খুব কৌশলে কাজ করতে হবে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ভেবে বলল
কিন্তু তোমার এই ছেলের কি এমন যোগ্যতা আছে যে
তুমি এই প্রস্তাব নিয়ে এসেছ? আমি যা দেখেছি ওকে শুধু কাটি কালা আর
তেলার কলস নিয়েই বসে থাকে সারাক্ষণ, আর কিছু তো করতে দেখি না। তাহলে বল কি
করে এই প্রস্তাব মেনে নিতে পারি?
বুজিবা তুমি একটু ভেবে কথা বল। দেখ, আমি নিজে
এসেছি তোমার এখানে
বুঝলাম, সবই ঠিক আছে
কিন্তু তোমার ছেলে একা আমার মেয়েকে পছন্দ করলেইতো হয় না ওকেও তো ওর ভাল লাগতে হবে
হ্যাঁ তা হতে হবে বৈকি, তুমি এক কাজ
কর ওকে একটু এখানে আসতে বল আমি জিজ্ঞেস করে দেখি
এ কথা শুনেই ঘর থেকে মালাইকা বের হয়ে সামনে এসে
দাঁড়িয়ে বলল
লিয়ের, আপনার সম্মান রক্ষা
করেই বলছি, আপনি আপনার ছেলের শুধু একটা যোগ্যতার কথা আমাকে বলুন
আমি জানি ওর এমন কোন যোগ্যতা নেই তবে ও কিন্তু
খুব ভাল ছেলে
খুব ভাল ছেলে দিয়ে আমি কি করব? বৌকে
খাওয়াবে কি? এই রকম অকর্মা মুরদ ছাড়া ছেলে আমার পছন্দ না।
দেখ, ও কিন্তু এই গ্রামের
লিয়েরের ছেলে!
হুম, ছেলেতো লিয়েরের কিন্তু
হয়েছেতো একটা বিড়াল। ওর গলায় কয়টা সিংহের দাঁত বা নিদেন পক্ষে কুমিরের দাঁত আছে
দেখাতে বলুন। এইযে দেখুন আমার গলার মালা, এটা গতবার আপনিই
দিয়েছিলেন
একটু থেমে আবার বলল
ওকে বলুন ও যদি আমার সাথে লড়াই করে জিততে পারে
তাহলে আমি ওকেই বিয়ে করব
লিয়ের নল দিয়ে তামাক টানছিল। মালাইকার এই কথা
শুনে হঠাৎ করেই ক্ষিপ্ত হয়ে বলল
তাহলে তুমি সরাসরি না বলছ?
না কোথায় বললাম, এইতো আমি
এখানেই দাঁড়িয়ে আছি ওর যোগ্যতা দিয়ে ওর গায়ের শক্তি দিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে যাক!
বলুন ওকে!
মেয়েকে যোগ্য শিক্ষাই দিয়েছ বুজিবা! ঠিক আছে আমি
উঠলাম কিন্তু এ জন্যে তোমাদের অনেক মূল্য দিতে হবে মনে রেখ। চল চিমা এই মেয়েকে তোর
বিয়ে করতে হবে না আমি তোর জন্যে এর চেয়ে ঢের ভাল মেয়ে খুঁজে দিব।
তাই করুন গিয়ে। আর একটা কথা শুনে যান, আমি আরযো
গ্রামের লিয়ের ওবির ছেলে আবেলের বাগদত্তা, সামনের
পূর্ণিমায় ওরা প্রস্তাব নিয়ে আসবে
কথাটা শুনে বুজিবা একটু অবাক দৃষ্টিতে মেয়ের
মুখের দিকে তাকাল। এ কি বলছে মেয়ে! কই, আমাকে কিছু বলেনি কেন? কথাটা শুনেই
ফোলামি ভীষণ ভাবে উত্তেজিত হয়ে বলল
এটা হতে পারে না, তুমি এই
গায়ের মেয়ে। এই গায়ের ছেলের সাথেই তোমার বিয়ে হবে
বলেই সিংহের মত গর্জাতে গর্জাতে উঠে চলে গেল।
ওরা চলে যাবার পর মালাইকার মা এসে ব্যস্ত হয়ে
বুজিবাকে বলল
এখন কি হবে? আমার মন
বলছে একটা দাঙ্গা হাঙ্গামা হবে
হবেইতো, ফোলামি কি
এমনিই ছেড়ে দিবে?
মালাইকার দিকে ঘুরে বলল
তুই আবেলের কথা আমাকে আগে বলিসনি কেন?
ভাবছিলাম ওরা প্রস্তাব নিয়ে এলেই জানতে পারবে
তাই কিছু বলিনি আবার এর মধ্যেই যে ওরা আসবে তা কি আমি জানতাম?
আমি আগে জানলে ফোলামিকে সেই ভাবে বলতাম
কালিশা বলল
যা হবার হয়েছে এখন কি করবে, লিয়ের
যেভাবে রেগে চলে গেল কি জানি কি করে?
উপায় একটা বের করতে হবে। গ্রামের সবার সাথে আলাপ
করে দেখি কে কি বলে। আরে, ওর পক্ষে এখন আর আগের মত কেউ নেই। শক্তিও
কমে গেছে লক্ষ করেছ? এখন বাঘ সিংহ কেন একটা ভেড়াও মারতে পারবে না।
তবে হাঙ্গামা অবশ্যই একটা হবে এবং আমাদের এ জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে।
ওরা একসাথে অনেকক্ষণ বসে রইল। বুজিবার হাতে
তামাকের নল। চিন্তিত।
একটু পরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল দাও দেখি কিছু খেতে
দাও। খেয়ে একটু বের হই।
৮।
বুজিবা বাড়ি থেকে চিন্তিত মুখে বের হয়ে তার
ঘনিষ্ঠ জনদের সাথে দেখা করে আজ সকালে ফোলামির ঘটনা নিয়ে আলাপ করল। সবাই এক বাক্যে
বলল।
আরে বাদ দাও, ও এখন
কি করবে? আমরা এখন নতুন লিয়ের বানাবার চিন্তায় আছি। কাজেই ওর
পক্ষে আর আমরা কেউ নেই, ও দাঙ্গা করবে কাকে
নিয়ে? তুমি কিচ্ছু ভেবো না।
বন্ধু বা ঘনিষ্ঠ জনেরা আশ্বাস দিলেও বাস্তবে
ভিন্নতা দেখা দিল। ফোলামি ভিতরে ভিতরে বেশ অনেকটা এগিয়ে আছে। ওর পক্ষেও অনেক লোক
আছে।
ফোলামির রাগ হবে না কেন, এই এত
টুক একটা মেয়ের কাছে হেরে যাবে? মেয়ে বলে কিনা
লিয়েরের ছেলে হলে হবে কি ও হয়েছে একটা বিড়াল। আবার বলে ওর শক্তি দিয়ে আমাকে এখান
থেকে তুলে নিয়ে যাকতো দেখি! কি আশ্চর্য! এর একটা উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। প্রতিশোধ
নিতে হবে। আমার মুখের সামনে এত বড় কথা!
আস্তে আস্তে দিন যাচ্ছে আর সারা গ্রামে কেমন
যেন একটা থমথমে ভাব ছড়িয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে চাপা উত্তেজনা। গ্রামের এ প্রান্ত থেকে
ও প্রান্ত পর্যন্ত এই এক কথা নিয়েই ফিসফাস কানাকানি। আশেপাশেও কিছুটা ছড়িয়ে গেছে।
সেদিন বুজিবার বন্ধু আদিসা কোসি গিয়েছিল সেখান থেকেও শুনে এসেছে। ওরা জিজ্ঞেস
করেছিল তোমাদের গ্রামে নাকি দাঙ্গা হতে যাচ্ছে? ফোলামি
আমাদের কাছে দূত পাঠিয়েছিল সাহায্যের জন্যে, আমরা
সম্মতি দিতে পারিনি। বুজিবার সাথে আমাদের অনেকদিনের ব্যবসা। শুধু তাই নয় ওর সাথে
আমাদের সম্পর্কটাও খুব ঘনিষ্ঠ কাজেই ওর বিরুদ্ধে আমাদের কিছু করা সম্ভব নয় বরং
বুজিবা যদি আমাদের সাহায্য আশা করে তাহলে আমরা নিষেধ করতে পারব না। আদিসা এসে
বুজিবাকে বলতেই বুজিবা বলল
তাহলে তুমি ওদের বলে এলেই পারতে!
বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার সম্মতি ছাড়া
বলা সঙ্গত হবে কিনা বুঝে উঠতে পারিনি। তুমি সম্মতি দিলে আমি কালই আবার যেতে পারি।
আচ্ছা অপেক্ষা কর দেখি অবস্থা কোন দিকে যায়।
দরকার হলে তুমি ওদের বলে আসবে।
৯।
মালাইকা ভাবছে আতো কেন আসছে না। কবে আসবে? বলে গেল
তাড়াতাড়িই আসবে কিন্তু একটা পূর্ণিমা চলে গেল এখনো কোন দেখা নেই! অবাক কাণ্ড!
এদিকে এই অবস্থা চলছে সে কি কোন সংবাদ পায়নি! এখনও হয়ত এত দূরে এই সংবাদ পৌঁছায়নি।
সংবাদ পেলে নিশ্চয় আসবে। আবেল না এসে পারবে না। ওকে আসতেই হবে। দরকার হলে দলবল
নিয়েই আসবে। সারা গ্রামের অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হতেই চলেছে। কি ভয়ংকর অবস্থা
দাঁড়াবে কে জানে! না জানি কতজন মরে যাবে! আমার জন্য একটা গ্রামের শান্তি নষ্ট হবে? এত
মানুষ মারা যাবে? কিন্তু আমিতো এমনটা চাই না! কি করব এখন? গ্রামের
এই পরিস্থিতি কি করে শান্ত করা যায়? আবেল এলে ওর সাথে
পরামর্শ করতে পারতাম কিন্তু ওকে জানাব কি করে? একদিকে
বিরহ জ্বালা আবার এদিকে পারিবারিক এমনকি সমস্ত গ্রামের শান্তির প্রশ্ন দেখা
দিয়েছে। এই অবস্থায় কি করা উচিত কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। বাবা কাজকর্ম ফেলে সারাদিন
এদিক ওদিক দৌড়া দৌড়ী করছে। মা উত্তেজিত, চিন্তিত, নীরব
কোন কথা বলে না মেজাজ খিটখিটে। গ্রামের পরিস্থিতি উত্তপ্ত। প্রতিটি ঘরে অস্ত্র
শস্ত্র শাণ দেয়া হচ্ছে, ধোয়া মুছা হচ্ছে, তীরে
বিষ মাখান হচ্ছে। যে কোন সময় শুরু হবে ভয়ংকর একটা কিছু। কি করা যায়?
১০।
এদিকে যখন এমন অবস্থা চলছে যখন বুন্না চাষের
সময় এসেছে তখন একদিন ওবি আবেলকে ডেকে বলল যা বুজিবাকে নেমন্তন্ন করে একেবারে সাথে
নিয়ে আয়, পারবি?
কবে যাব?
কালই যা
আচ্ছা
আবেল আটনাগো যাবার সুযোগ খুঁজছিল। কতদিন হয়ে
গেল মালাইকার সাথে দেখা হয় না কথা হয় না। কি ভাবছে সে? ওদিকে
আবার বলে এসেছে আমি তাড়াতাড়িই আসব। বাবার কথা শুনে দেরি না করে কালই যাবার জন্য
তৈরি হলো। সকালে তার প্রিয় গাধাটাকে ভাল করে খাবার পানি খাইয়ে মাকে বলে বের হলো।
সারা পথে আবেলের মনের আনন্দ দেখে কে? আজ তার মিনার
(প্রেমিকা) এর সাথে দেখা করতে যাচ্ছে! মনের সুখে গান ধরল। গাধাটা কেন আর একটু জোরে
হাঁটছে না! মনে মনে অনেক স্বপ্ন দেখতে দেখতে একসময় সেদিনের মত সময়েই আটনাগো গ্রামের
সীমানায় পাহাড়ের উপরে এসে পৌছার আগেই কয়েকজন সশস্ত্র মানুষ মিলে দূর থেকে হাঁক
দিয়ে আবেলকে থামাল। কাছে এলে নানা প্রশ্ন! কোথা থেকে এসেছে, কেন
এসেছে, কোথায় যাবে এইরকম নানা প্রশ্ন। আবেল অবাক হলো, এর আগে
যখন এসেছে তখন এমন কিছু হয়নি। তার মানে কি দাঁড়াচ্ছে? নিশ্চয় এই গ্রামে কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
দাঙ্গা হাঙ্গামার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে! কিন্তু কি হয়েছে, কেন
হচ্ছে? জানতে হবে। যারা পথ রোধ করেছিল তারা ওর জবাব শুনে কেমন
করে যেন আশ্বস্ত হয়ে ওকে ছেড়ে দিল।
আবেল বুজিবার বাড়িতে পৌঁছে বাইরে থেকে হাঁক
দিল
বুজিবা বাড়ি আছ?
মালাইকা উঠান ঝাড়ু দিচ্ছিল, এই শব্দ
এই কণ্ঠ শোনার জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করে আছে । আহা কি মিষ্টি পৌরুষ ভরা গমগমে
কণ্ঠ। কথা শুনেই মন ভরে উঠে। শোনার সাথে সাথে দৌড়ে বাইরে এসে দেখে গাধার রশি ধরে
আবেল দাঁড়িয়ে। দুইজনেই হতবিহবল হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। কেউ কথা বলতে পারছে
না। বেশ অনেকক্ষণ এভাবে থাকার পর মালাইকার সম্বিত ফিরে এলো।
তুমি কোথায় ছিলে আবেল? এত দেরি
করে কেন আসলে? কেন আরও আগে আসলে না? জান
এদিকে কি সব হচ্ছে?
কি হচ্ছে? আমি পথে
কিছুটা অনুমান করেছি। ওরা আমার পথ আটকে নানা জিজ্ঞাসাবাদ করে তবে আমাকে এ গ্রামে
ঢুকতে দিয়েছে। কি হয়েছে বল
মালাইকা আবেলকে নিয়ে ভিতরে এসে মাকে জানিয়ে
ওকে বসতে দিয়ে বলে গেল বস আমি আসছি।
একটু পরে কিছু ফলমূল আর বুন্না এনে আবেলের
সামনে টুলে নামিয়ে রেখে এদিক ওদিক দেখে শুরু থেকে আজ অবধি যা যা ঘটেছে এবং গ্রামের
বর্তমান পরিস্থিতির কথা বিস্তারিত জানাল। এবার একটু থেমে ফিসফিস করে এ ব্যাপারে সে
নিজে কি ভাবছে তাও বলল।
শুনে আবেল স্তম্ভিত হয়ে গেল।
বল কি? এমন
দুঃসময়ে আমাকে একটু খবর দিতে পারলে না?
অত দূরে কাকে দিয়ে খবর দেই বল!
তুমি বুজিবাকে আমার কথা বলনি?
আগে বলিনি পরে বলেছি
আগে বলনি কেন?
ভাবছিলাম তুমিইতো আসছ তাই
বুজিবা আমার বাবার বন্ধু সে এ সংবাদ জানলেই
আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে আসতাম। আমার মিনারকে ছিনিয়ে নেয় এমন সাধ্য কার? এই
তল্লাটে এমন কেউ নেই। আমি এখুনি বাড়ি যাচ্ছি এবং আমার পুরো গ্রাম নিয়ে আসছি তুমি
বুজিবাকে একটু অপেক্ষা করতে বলবে।
বলেই উত্তেজিত ভাবে উঠে দাঁড়াল। মালাইকা
আবেলের হাত চেপে ধরে আবার বসিয়ে দিয়ে বলল
না না তুমি ভুলেও এই কাজ করতে যেও না। কি
বললাম তোমাকে? বুঝনি? মাথা গরম করছ কেন?
না না মালাইকা তুমি যা বলছ তা হতে পারে না, ওদেরকে
একটা উচিত শিক্ষা দিতে হবে। ওরা জানে না কার মিনারের দিকে চোখ তুলেছে!
মালাইকা অনেক কষ্টে আবেলকে থামাল।
একটু শান্ত হলে মালাইকা আবার জিজ্ঞেস করল
আমি যা বলেছি তুমি কি বুঝতে পেরেছ?
বুঝেছি কিন্তু আমার মন মানছে না যে!
কেন মন মানছে না? মনকে যে
মানাতেই হবে! তুমি কি চাও আমাদের জন্য এত বড় ক্ষতি হোক?
আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না মালাইকা, তুমি
কেন ওদের উচিত শিক্ষা দিতে নিষেধ করছ!
বললামতো, আমাদের
জন্য এত বড় অশান্তি হবে, কত মানুষ মরে যাবে
এই কি তুমি চাও? তার চেয়ে আমরা যদি এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাই তাহলে
এর কিছুই হবে না। আবার ওদিকে আমরাও সুখেই থাকব। এটাই কি ভাল হয় না?
সে তো ভাল হয় কিন্তু ওদের একটা শিক্ষা দিতে
হবে না?
শিক্ষা দিয়ে কি লাভ হবে?
বেশ তুমি যদি না চাও তাহলে হবে না, তুমি যা
বলবে তাই হবে। এখন বল কিভাবে কি করতে হবে।
মালাইকা এদিক ওদিক দেখে আবেলের একটু কাছে
এসে ফিসফিস করে যা বলল
সামনের পূর্ণিমার রাতে আমরা পালাব। তুমি ঠিক
মাঝ রাতে দেদেসা পার হয়ে বনের পথ ধরে কোসি গ্রামে এসে থাকবে আর আমি সন্ধ্যার পর
সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পরলে এখান থেকে বের হয়ে কোসি পৌঁছব। ওখানে তোমাদের গ্রামের
যে পথ বনের মধ্যে দিয়ে এসে কোসি পৌঁছেছে সেখানে আমরা মিলিত হয়ে পরে নিকেমতা যেয়ে
আমার মামার বাড়ি উঠবো। শুনেছি নিকেমতা অনেক বড় শহর কাজেই এরা কেউ জানবে না আমরা
কোথায় আছি।
পূর্ণিমা রাতে কি করে পালাবে? সে রাতে
কেউ দেখে ফেলবে না?
আমাদের গ্রামের খবর আমি ভালই জানি, তাছাড়া
এখন এখানে সে পরিস্থিতি নেই, আর থাকলেও কোথা
দিয়ে পালাতে হবে কোন পথে গ্রামের বাইরে যেতে হবে সে আমার ভাল চেনা আছে তোমাকে এ
নিয়ে মোটেই ভাবতে হবে না।
আচ্ছা ঠিক আছে, তারপর?
তারপর আবার কি?
ওখানে আমরা কি করব?
মামার কোন ছেলে মেয়ে নেই ইচ্ছে হলে ওখানেই
থাকব কিংবা পরে যদি তোমার ভাল না লাগে তাহলে আমরা আরযোতেও ফিরে আসতে পারি তবে
এখানে আর নয়।
খারাপ বলনি। তাহলে আমি বাড়ি ফিরে যাই। আর
মাত্র দুই রাত পরেই পূর্ণিমা।
এবারে এখানে কেন এসেছে সে কথা বলে বলল তুমি
বুজিবাকে বলবে আমি কেন এসেছিলাম এবং কখনও দরকার হলে বাবাকে খবর দিতে যেন ভুলে না
যায় সে কথা মনে করিয়ে দিও।
সে যা বলার আমি বলব এ নিয়ে তোমাকে চিন্তা
করতে হবে না।
১১।
ভরা পূর্ণিমার রাত। আটনাগো গ্রামে বুজিবার
বাড়িতে সন্ধ্যার একটু পরে প্রতিদিনের মত সবাই খেয়ে দেয়ে যার যার ঘরে শুয়ে পড়েছে।
মালাইকাও এসে ওর ঘরে শুয়ে মা বাবার নাক ডাকার অপেক্ষা করছে। একটু পরেই মা বাবা
দুইজনেরই নাক ডাকার শব্দ পেয়ে উঠে ঘরের বাইরে এসে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক দেখল। সব ঠিকঠাক
আছে। দুই ফালের একটা অত্যান্ত ধারালো ছুরি আর একটা বিষ মাখা বর্শা আগেই লুকিয়ে
রেখেছিল। এবার ছুরিটা কোমরে গুজে নিল আর বর্শা হাতে এসে বাড়ির বাইরে বাবলা গাছের
নিচে দাঁড়াল। ডাইনে বায়ে ভাল করে দেখে
নিল। জোসনা রাতে সামনে যতদূর দৃষ্টি যায় দেখে নিশ্চিত হয়ে আবার পিছনে ফিরে তাকাল।
এ বাড়িতে এই তার শেষ পায়ের চিহ্ন। এর পরে তাকে আর এখানে কেউ দেখবে না। শৈশবের
স্মৃতি জড়ান অনেক কথা ঝরের মত মনে আসল। এই বাবলা গাছেরও কত স্মৃতি জড়ান আছে তার
জীবনে কিন্তু এখন আর সে সব মনে করার কোন উপায় নেই। তাকে এখন যেতে হবে অনেক দূরে
যেখানে তার জন্যে অপেক্ষা করবে তার কেরেল। সে এখান থেকে চলে গেলে রক্ষা পাবে
অনেকগুলি জীবন। গ্রামের শান্তি বজায় থাকবে, কোন
দাঙ্গা হাঙ্গামা হবে না, কেউ আর উত্তেজিত হবে না। সারা গ্রাম জুরে ফিসফিস কানাকানি
বন্ধ হয়ে যাবে। আগের মত সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। প্রথমে উলটো পথে গ্রাম থেকে বের হতে
হবে। বাড়ি থেকে বের হয়ে বায়ের চরাই উৎরাই রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে আবার বায়ে মোড়
নিয়ে আরও কিছু হেঁটে গ্রামের বাইরে এসে সোজা হাঁটা শুরু করল পাহাড়ের দিকে। বুক ঢিপ
ঢিপ করার মত মেয়ে মালাইকা নয়। সে একা একটা নেকরে বাঘ মেরে বীরের পরিচয় দিয়েছে। এই
মেয়েকে কি ভয় পেতে আছে?
সামনে পাহাড়ের উপরে উঠে এসে আবার সামনে দেখে
পথ খুঁজে নিল। জোসনা রাতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চতুর্দিকে ছোট বড় নানা আকারের
পাহাড়, কখনও পাহাড়ের উপর দিয়ে, কখনও
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আবার কখনও দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলা পথ। কোথাও পাথুরি পথ কোথাও বালু আবার কোথাও হালকা ঘাস মানুষের
চলাচলে মসৃণ হয়ে আছে। মালাইকা চলছেতো চলছেই, চিতা
বাঘের মত দৌড়ে চলছে। তাকে যেতে হবে অনেক দূরের কোসি গ্রামে যেখানে আরযো গ্রামের
দেদেসা নদীর পাড় থেকে বনের ভিতর দিয়ে বুনো পথ এসে মিশেছে। যে পথে আসবে তার কেরেল।
পথ হারালে চলবে না। পথের মাঝে প্রতিটা পাহাড়ের উপরে উঠেই আগে দেখে নিচ্ছে তার পথ
ঠিক আছে কি না এই ফাকে হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিচ্ছে।
১২।
আরযো গ্রামে আজও আগের সব পূর্ণিমার মত পূর্ব
আকাশে ভরা চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। চারিদিকে চাঁদের আলো খৈ খৈ করছে। দূরে, অনেক
দূরের সব কিছু পরিষ্কার দেখা যায়। গ্রামের মাঝখানে বসেছে নিয়মিত নাচ গান আর পানের
আসর। নারী পুরুষ সবাই এসেছে। কেও নাচছে, কেও গাইছে, কেও
বাজাচ্ছে আবার কেও দেখছে এবং কাটি কালা, তেলা পান করছে। আবেলের মা এবং বাবাও এদের
সাথে কোথাও মিশে আছে। বাড়িতে একা আবেল শুধু প্রহর গুনছে আর স্বপ্ন দেখছে। মালাইকা
কি বাড়ি থেকে গ্রাম থেকে বের হতে পেরেছে? রাতের পথ কি ঠিক মত
চিনে আসতে পারছে? এখানে আকাশ ভরা জোসনা, আটনাগো
গ্রামেও কি এমনি জোসনা উঠেছে? প্রিয়তমা মালাইকা
কি পথ দেখে চলতে পারছে? সাথে দুই একটা
অস্ত্র আনতে ভুল করেনিতো? মনে কত প্রশ্ন আসছে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর বাবা মা আসরে
গেলে পরে নদীর পাড়ে গিয়ে দেখে এসেছে ভেলাটা ঠিক আছে কি না। না থাকলেও অসুবিধা নেই
এইটুক নদী সাতরেই পার হতে পারবে। নদীতে দুই একটা ঘড়িয়াল আর গুই সাপ ছাড়া তেমন কিছু
নেই। কুমির এখানে মোটেই নেই। বনের পথে যাবার জন্য বিষ মাখা একটা বর্শা আর তার
প্রিয় একটা ছুরি রেডি করে রেখেছে। বনে চলার মন্ত্র আওড়ে দেখছে মনে আছে কি না।
চাঁদটা যখন ঠিক মাথার উপরে আসবে তখনই বাড়ি থেকে বের হতে হবে। বাবা মা এসে ডেকে কোন
জবাব না পেলে ভেবে নিবে ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে উঠে খোজ হবে ততক্ষণে তারা নিকেমতার
পথে থাকবে।
এমনি সব ভাবনায় মগ্ন হয়ে বাড়ির উঠানে
পায়চারী করছে আর চাঁদটা মাথার উপরে আসার অপেক্ষা করছে। এক সময় দূরে বনের দিকে একটা
রাতের পাখি ডেকে উঠল। তার শব্দে আবেলের ধ্যান ভেঙ্গে গেল। আকাশে তাকিয়ে দেখে
চাঁদটা ঠিক মাথার উপর এসে দাঁড়িয়েছে। এইতো! বের হবার এটাই উপযুক্ত সময়। এখনও মা
বাবা ফিরে আসেনি। তাদের ফিরে আসতে আরও কিছু সময় লাগবে। আর দেরি না করে এখনই বের
হতে হবে। মায়ের ঘরে ঢুকে মাটির পেয়ালা ভরে একটু পানি খেয়ে বন দেবতার নাম স্মরণ করে
অস্ত্র গুলি সাথে নিয়ে বের হলো।
নদীর ঘাটে এসে ভেলায় চড়ে এ পাড়ে এসে আবার বন
দেবতার নাম স্মরণ করে ভেলা থেকে বনের পথে পা নামাল। এই পথে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে
প্রায় আধা মাইলের মত যেতে হবে তারপরে মাইল খানিক রুক্ষ উঁচু নিচু টিলা মাঝে মাঝে
কিছু বড় বড় গাছ আর সামান্য কিছু ঝোপ, তারপরে আধা মাইলের
মত সমতল পথ। এদিক ওদিক দেখে ঝোপ ঝাড়ের ডাল পালা লতা পাতা সরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে
যাচ্ছে। বনের মধ্যে নানা রকম শব্দ কানে আসছে। সিংহ, বাঘ, হাতি, বানর
এবং আরও নানা পশু পাখির নানান শব্দ। কোনটা কাছে থেকে আবার কোনটা দূর থেকে। এখানে
ঘন জঙ্গল বলে জোসনার আলোয় পথ আলোকিত হতে পারছে না তবুও মিনারের উদ্দেশ্যে এই
যাত্রা তাই রাতের অন্ধকারেও নির্ভয়ে এগিয়ে চলেছে। প্রায় দৌড়ে যাচ্ছে কিন্তু ঘন ঝোপ
ডিঙ্গিয়ে বেশি এগুতে পারছে না। মনে শুধু একটাই ভয় কি জানি মিনার এসে কতক্ষণ
অপেক্ষা করে! তার এসে পৌছার আগেই কোসি পৌছাতে হবে।
এক সময় ঘন জঙ্গল এলাকা পার হয়ে এলো। এখন
শুরু হলো উঁচু নিচু টিলার উপর নিচ দিয়ে পথ। পথে আবার কিছুদূর পানিও আছে। তবে এখানে
জোসনার আলো পাচ্ছে। চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সাবধানে সামনে এগুতে হচ্ছে। চোখ, নাক, কান এবং
অনুভূতি সহ সমস্ত ইন্দ্রিয় সতর্ক রাখতে হচ্ছে। একটু দাড়িয়ে গন্ধ শুকে দেখল, আশেপাশে
কোন হিংস্র প্রাণীর গন্ধ পাচ্ছে না। দূর থেকে রাজার হুংকার কানে এলো তবে কোন দিক
থেকে এসেছে বুঝতে না পেরেই এগিয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। সামনে
ওটা কি? রাজার (সিংহ) মত মনে হচ্ছে! হ্যাঁ তাইতো! পা টিপে টিপে
ডান পাশের বড় গাছটার আড়ালে দাঁড়াল। মন্ত্র পড়ছে। গাছের উপরে দেখে নিল কোন চিতা গাছের
ডালে বিশ্রাম নিচ্ছে কিনা। বনের নিয়ম হলো রাজা মশাইয়ের নাম মুখে আনতে নেই। সে
এদিকেই এগিয়ে আসছে। একটা। একটু পরেই আরও দুইটা। এখানে নিরাপদ নয় কিন্তু কোথায় যাবে? যে
গাছের আড়ালে দাঁড়িয়েছে ওটায় উঠবে? বাতাস উলটো দিক
থেকে আসছে বলে সে ওদের গন্ধ পাচ্ছে তবে ওরা এখনও ওর গন্ধ পায়নি। গাছে উঠলে নিচে
দিয়ে যাবার সময় গন্ধ পাবে। আর তাই যদি হয় তাহলে সারা রাত এমনকি ও নিচে না নামা
পর্যন্ত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে এবং এর মধ্যে দুই এক জনে গিয়ে অতিথি নিমন্ত্রণ করে
আনবে। কি করা যায়? পিছনে ঘুরে দৌড় দিবে? তাহলে
এখানে এলেই গন্ধ পাবে আর সেই গন্ধ শুকে শুকে ও যেখানে আছে সেখানেই চলে যাবে। তাহলে
কি করা যায়? গাছেই উঠি!
দরকার হলে সাত দিন গাছেই বসে থাকব। না, এটা হবে
মারাত্মক সিদ্ধান্ত! তা হলে?
আচ্ছা, বাতাস
বামদিক থেকে কোণাকুণি ভাবে আসছে কাজেই পথ ছেড়ে ডানে ঘুরে গেলেই আর গন্ধ পাবে না।
ভাবা মাত্রই সিদ্ধান্ত, এটাই এক মাত্র পথ।
সঙ্গে সঙ্গে পথ ছেড়ে ডান দিকে নিঃশব্দে দৌড়ে সোজা চলে গেল প্রায় মাইল খানিক। ওরা
আস্তে আস্তে আসছে তাই অতক্ষণে ওর গন্ধ ওখানে থাকবে না। যত দূরে গেলে ওর গন্ধ পাবে
না অন্তত অতখানি-তো যেতেই হবে! এখানেও সামনে কি যেন দেখে একটু থামল। সামনে মনে
হচ্ছে এক পাল হাতি। পিছনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না। হাতিগুলি বেশ অনেকগুলি গাছের
পাশে কেও দাঁড়িয়ে কেও বসে। হাতি অন্তত পিছনে দৌড়াবে না। নিরাপদ মনে করে এবার এগুতে
আরম্ভ করল। এবার পথের কাছে আসতে হবে। আস্তে আস্তে বায়ে কোণাকুণি ভাবে পথের দিকে
এগুচ্ছে। সামনে ডানে বায়ে সমান দৃষ্টি রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলোতে বুঝতে
পারছে না পথ আর কত দূরে। হাতির পাল যেমন ছিল তেমনই আছে ওদের কোন বিকার নেই। সামনের
যে টিলা ওতে উঠে দেখতে হবে পথ কোন দিকে এবং কত দূরে। এগিয়ে যাচ্ছে। টিলার উপরে উঠে
চমকে উঠল। এ কি? এখানেও সামনে বায়ের টিলার উপরে এক পাল রাজা বসে আছে!
সম্ভবত ওখানে যাদের দেখেছে তাদের দলেরই হবে। এদের সামনে দিয়ে যাওয়া যাবে না।
মহা সমস্যা! আকাশের চাঁদের দিকে দেখল, এর
মধ্যেই পশ্চিম দিকে অনেকখানি নেমে এসেছে। হাতে সময়ও বেশি নেই। তাড়াতাড়ি একটা কিছু
করতে হবে। মালাইকা এসে কোথায় অপেক্ষা করবে? সামনের
পথ বন্ধ। আবার কি ডান দিকে বনের ভিতর এলোপাথাড়ি পথে ঘুরে যাব? দাঁড়িয়ে
অনেকক্ষণ ভাবল। কোন বুদ্ধি খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ খুব শীগগিরই কিছু একটা করতে হবে।
একা একজন রাজা হলেও সামনা সামনি যুদ্ধ করা যেত কিন্তু এরা রয়েছে দল বেধে। দলের
সাথে কিছুতেই পেরে ওঠা সম্ভব নয়। ভাবতে ভাবতেই চারিদিকে দেখল। মুখে আঙ্গুল দিয়ে
থুথু দিয়ে ভিজিয়ে বাইরে এনে সামনে ধরে দেখল বাতাস বাম দিক থেকেই আসছে এখনও। দেরি
না করে আবার ডান দিকে দৌড় শুরু করল। কিছুদূর যেতেই সামনে দুই টিলার মাঝে এক জলাভূমি
পরল। কিনারের বুনো ঘাস পাড় হয়ে পানির উপর দিয়েই হাঁটছে। লক্ষ করেনি যে ওপাড়ে ডান
দিকে একটু দূরে ঝোপের পাশে রাজা রানী এক সাথে পানি পান করছে। আবেল একটু অসাবধানে
পানিতে পা ফেলার সাথে সাথে যে শব্দ হলো এই শব্দই হলো কাল। রাজা রানী দুই জনেই এই
দিকে তাকিয়ে দেখল আবেল এ পাড়ের দিকেই এগিয়ে আসছে। পানি পান করে জলার কিনার ধরে
আবেল যেখান দিয়ে পার হচ্ছে বুনো ঘাসের আড়াল দিয়ে তার বরাবর এসে ওত পেতে রইল।
কিনারার কাছাকাছি আসার সাথে সাথে এক লাফ দিয়ে আবেলের গলায় কামড়ে ধরল। হাতের ছুরি
কিংবা বর্শা কিছুই কাজে লাগাবার সুযোগ পেল না। শুধু একটা চিৎকার করতে পারল মালাইকা.............................................
সমস্ত বন জুরে এই চিৎকারের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো মালাইকা, মালাইকা, মালাইকা
বলে। পাশের গাছ থেকে কয়েকটা পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে গেল অজানা আশ্রয়ে।
১৩।
মালাইকা চলছে তো চলছেই। চাঁদ যখন মাঝ আকাশে এলো তখন এক
মুহূর্তের জন্য থামল। আবেল কি সময় মত বের হতে পেরেছে? না, থামার সময় নেই। চলতে চলতে এক সময়
আরযো থেকে বনের মধ্যে দিয়ে যেখানে মেঠো পথ কোসি গ্রামে এসে মিশেছে ক্লান্ত হয়ে
সেখানে এসে পৌঁছল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল চাঁদ পশ্চিম আকাশের মাঝা মাঝি এসেছে।
আশেপাশে এদিক ওদিক দেখল কিন্তু কোথাও তার কেরেল আবেলকে দেখতে পেল না। পথের ধারে একটা গাছের নিচে বসে কোমরে ছুরির অস্তিত্ব
দেখে পরনের পোষাক দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিল। হাতের বর্শা হাতেই আছে। চাঁদ আরও হেলে
পরেছে কিন্তু তার আবেল আসছে না কেন? তবে কি ও আসেনি? না না এ হতেই পারে না! এত দেরি হচ্ছে কেন? এমন হবার কথা নয়! পথে
কি কোন বিপদ হয়েছে? না
না, তার আবেলের কোন বিপদ
হতে পারে না। অনেকক্ষণ বসে নানা কিছু ভাবল। চাঁদ আরও পশ্চিমে ঢলে পড়েছে ভোর হতে
খুব বেশি দেরি নেই।
কি করব এখন? অনেক কিছু ভেবে উঠে দাঁড়াল। কোমরের ছুরিটা ডান হাতে নিল বাম
হাতে বর্শা। আস্তে আস্তে বনের পথে পা বাড়াল। এদিকটায় সমতল ভূমি, একটু দূরে দূরে বড় বড়
গাছ আর ছোট ছোট কিছু বুনো ঝোপ। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। দেখতে দেখতে অনেকটা পথ
চলে এসেছে,
সামনে
এবং আশেপাশে দুই একটা টিলা দেখা যাচ্ছে। চোখ, নাক, কান সতর্ক রেখে মালাইকা এগিয়ে
যাচ্ছে। একটা টিলার ঢাল বেয়ে উপরে উঠছে। টিলার উপরে উঠে বনে বসবাস কারিদের অভ্যাস
মত চারিদিকে দেখল। সবই ঠিক আছে আশেপাশে কিছু নেই। আবার এগিয়ে যাচ্ছে। একটা টিলা
পার হয়ে এসেছে কিন্তু এখনও আবেলের দেখা নেই। কোথায় গেল? ভাবতে ভাবতে লক্ষ করেনি তার পিছনে
স্বয়ং রাজা তাকে অনুসরণ করছে। রাজারা এভাবেই নিঃশব্দে শিকারের পিছনে অনুসরণ করে।
সামনের টিলার উপরে উঠে পাশের একটা বাবলা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখে নিল।
পিছন থেকে বাতাস আসছে। সবগুলা
ইন্দ্রিয় সজাগ, পিছনে ঘুরে দাঁড়াল। কেমন যেন গন্ধ আসছে! হ্যাঁ তাইতো, রাজা মশাই! যে পথ পেরিয়ে এসেছে সেদিকে তাকাতেই দেখল একটু দূরে রাজা
মশাই দাঁড়িয়ে। পিছনে পিছনে আসছিল ওকে থামতে দেখে ওটাও থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে হাতের
দুই অস্ত্র নিয়ে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হলো। কি করবে এখন? কাটা বাবলা গাছে ওঠা যাবে না, বোঝাই কাটা।
ক্ষুধার্ত রাজা মশাই অনেকক্ষণ এক ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ঘাড়ের
কেশর ফুলে উঠেছে। শিকার ধরার জন্য প্রস্তুত। এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে আর
মালাইকাও তার অস্ত্র গুলি শক্ত হাতে ধরে প্রস্তুত। দ্রুত গতিতে শ্বাস প্রশ্বাস
চলছে, দুরন্ত গতিতে বুক ওঠা নামা করছে, কপাল বেয়ে ফোটা ফোটা ঘাম ঝরছে। জীবন মরণের লড়াই সামনে অপেক্ষা করছে। বন
দেবতার নাম স্মরণ করে মন্ত্র পড়ছে। ভোরের আলো ফুটে উঠতে চাইছে। রাজা মশাই আরও একটু
কাছে এসে আবার দাঁড়াল। দুইজনেই চোখে চোখে তাকিয়ে আছে। কে আগে কাকে আক্রমণ করবে!
অনেকক্ষণ এভাবেই কেটে গেল। মালাইকা কোন অবস্থাতেই আগে আক্রমণ করবে না। ওর আক্রমণের
অপেক্ষায় প্রস্তুত। ও লাফ দেয়ার সাথে সাথে ডান হাত সহ ছুড়িটা আস্ত মুখের ভিতর
ঢুকিয়ে দিবে, সম্ভব হলে বর্শাটা গলায় গেঁথে
দিবে তারপরে যা হবার হবে।
দম বন্ধ করা মুহূর্ত কাটছে কিন্তু
কেও কাওকে আক্রমণ করছে না। ওর দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরাবার কোন পথ নেই। মালাইকা একটু
এদিক সেদিক করলে বা অমনোযোগী হলে সাথে সাথেই লাফ দিবে! ভয়ংকর অপেক্ষায় দুই প্রাণী
শুধু আক্রমণের ক্ষণ গুনছে। যে কোন মুহূর্তেই ঘটবে একটা ভয়ংকর কান্ড। হঠাৎ পিছনের
পা দুইটা একটু নিচু হতেই মালাইকা মাথাটা বাম দিকে কাত করে ডান হাতের ছুরি বাড়িয়ে
দিল আর ওমনিই দেখল ওর ডান হাত রাজা মশাইয়ের মুখের ভিতর ঢুকে গেল সঙ্গে সঙ্গে
ছুরিটা ছেড়ে দিয়ে বাম হাতের বর্শাটা দিয়ে গলায় এক পার বসিয়ে দিল, সামনের থাবার ধাক্কা লেগে মালাইকা পরে যেত কিন্তু বর্শাটা গভীর ভাবে
গেঁথে গেছে এবং বর্শার এক প্রান্ত মালাইকার হাতে ধরা রয়েছে বলে পড়ল না তবে এক পায়ের
থাবা বুকে গেঁথে এক তাল মাংস ছিঁড়ে নিয়ে গেল। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা হয়ে
দাঁড়িয়ে টেনে বর্শা ছাড়িয়ে নিয়ে আবার গেঁথে দিল পেটের ভিতরে। সিংহটা মুখের ভিতরে
বেধা ছুরি নিয়ে এবং গলায় আঘাত পেয়ে বিকট এক হুংকার দিয়েই পড়ে গেল। যা হবার
মুহূর্তের মধ্যেই হয়ে গেল। মালাইকা লাফ দিয়ে একটু দূরে দাঁড়াল এবং আহত সিংহ আবার
লাফ দিয়ে উঠে ওর দিকে আর এক লাফ দিল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মালাইকা সরে দাঁড়াল আর ওটা
একটু দূরে আছড়ে পড়ল। এত কিছু করেও মালাইকা রক্ষা পেল না। পিছনেই যে রানী আসছে সেটা
মালাইকার চোখে পড়েনি। রানী এসে তার সাথীকে এভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় দেখেই এক লাফ
দিয়ে মালাইকার ডান কাধে কামড়ে ধরে দৌড়ে চলল। পা গুলি মাটিতে হেচড়ে যাচ্ছে।
১৪।
ভোরে ওবি আর রামলা ঘুম ভেঙ্গে
বাইরে এসে আবেলকে ডাকাডাকি করেও কোন সারা না পেয়ে ঘরে ঢুকে দেখে দরজা খোলা এবং আবেল
ঘরে নেই। ভাবল হয়ত আশেপাশেই কোথাও আছে। কিন্তু বেলা বাড়ছে অথচ আবেলের কোন দেখা নেই
তখন ভাবল কি ব্যাপার আবেলের কি হলো কোথায় গেল? কখনও এমন হয়
না। এর মধ্যে গ্রামের একজন ঘাটের দিক থেকে ওদের বাড়ির কাছে দিয়ে যাবার সময় ওবিকে
ডেকে বলল
ভেলাটা নিয়ে ওপাড়ে গেল কে?
কেন, কি হয়েছে?
ভেলাটা দেখলাম ওপাড়ে রয়েছে!
ওপাড়ে কে যাবে! কই আমাকে কেও কিছু
বলেনি তো কে গেছে? তবে আবেলকে খুঁজে পাচ্ছি না!
তাহলে কি আবেল গেছে নাকি?
কি জানি আবেলের ওপাড়ে কি কাজ
থাকতে পারে, ও একা কেন ওখানে যাবে?
আবেলের মা অস্থির হয়ে বলল
দেখ খুঁজে দেখ আমার মনে হয় আবেলই
ওপাড়ে গেছে
আগন্তুক একটু উপযাচক হয়েই বলল
আমার মনে হয় সবাই মিলে একবার
খুঁজে দেখলে হয় না? কেওতো নিশ্চয় গেছে কিন্তু কে গেছে
আমরা জানতে পারছি না কাজেই একবার দেখি, আমি যাই সবাইকে
ডেকে আনি। কি বল ওবি?
যাবে?
নিজের ছেলের কথা ভেবে বলল
চল তাহলে দেখি কি ব্যাপার!
মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত গ্রাম জড়
হয়ে গেল। সবার সাথে নানা রকম অস্ত্র, মশাল এবং যা
যা নিয়ে বনে যেতে হয় সব কিছু নিয়ে ওবির বাড়ির পাশে হাজির।
চল সবাই নদীর ঘাটে চল
এর মধ্যেই একজন সাতরে যেয়ে ওপাড়
থেকে ভেলাটা নিয়ে এসেছে।
ভেলায় করে নদী পার হয়ে হৈ হৈ করে
হাঁক ডাক ছেড়ে মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে এগিয়ে চলল। বনের ডালপালা লতাপাতার এলোমেলো ভাব
দেখে ওরা বুঝে নিল কেও একজন খানিক আগে এই পথে গেছে। সন্দেহ দূর হলো। কেও বনে এসেছে
কিন্তু কেন এবং কোথায়? দিনের আলোতে ভাঙ্গা ডালপালা আর ছেড়া
লতাপাতার চিহ্ন ধরে দল এগিয়ে চলছে। বনের পথ শেষ হলো, এবার
পায়ের ছাপ খুজে পেল। পায়ের ছাপ দেখে দেখে টিলার উঁচু নিচু পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। এক
সময় সেই গাছটার কাছে এসে পায়ের ছাপ থেমে গেল। পায়ের ছাপ এখানে ইতস্তত ছড়ানো রয়েছে
সম্ভবত কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। গাছটার নিচেই বেশী ছাপ। গাছের উপরে দেখল, না
গাছে ওঠার কোন চিহ্ন নেই। পথের বাইরে আশে পাশে ছোট দুর্বা ঘাস, এখানে বুঝতেই পারছে
না এর পরে পায়ের ছাপ কোন দিকে গেল। ওবির সিদ্ধান্তে ওরা সামনেই এগিয়ে যাবার পথ
ধরল। বেশ অনেকটা পথ পেরিয়ে ওই জলাভূমি পার হয়ে একটু এগিয়ে সামনে দেখল পথের উলটা
দিক থেকে একটা কিছু টেনে নেয়ার দাগ এসে ডান দিকে গেছে, মাঝে
মাঝে তাজা রক্ত। এই চিহ্ন ধরেই পথ ছেড়ে ডান দিকে এগিয়ে গেল দলটা। পথ ছেড়ে একটু
এগিয়ে সামনের টিলার উপরে উঠে দেখল পরের টিলার উপরে বেশ কয়েকটা ছোট বড় গাছের নিচে
পাঁচ ছয়টা সিংহ বসে আছে। ওদের হৈ চৈ শুনে প্রায় সবাই উঠে দাঁড়াল। সিংহের স্বভাব
সুলভ গম্ভীরতা নিয়ে এদিকে তাকিয়ে দেখছে। কয়েক জনে তীরের মাথায় বাধা ঘাসের গোলায়
আগুন ধরিয়ে ধনুক দিয়ে ওদের দিকে ছুড়ে মারল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে এই তীর ছোড়া হলো, দুই
একটা সিংহের গায়েও লেগেছে। এতে কাজ হয়েছে। একে একে প্রায় সবাই ওই দিকে চলে গেল।
ওবির দল এগিয়ে কাছে গিয়ে দেখে একটা ছেলের উপরে একটা মেয়ের দেহ পড়ে রয়েছে। ছেলেটার
পিঠ থেকে নিচের অংশ প্রায় খেয়ে ফেলেছে।
ছেলেটার রক্ত মাখা মুখ দেখে চিনতে পারল আবেল। কিন্তু মেয়েটা কে? দুইজনে মিলে রক্তাক্ত মেয়েটাকে ধরে দেখল এখনও শরীর গরম, বুঝল মেয়েটা এখনও
জীবিত। কোলে তুলে দেখল বুকের এক পাশে হাড় দেখা যাচ্ছে, জিজ্ঞেস
করল তুমি কে? ক্ষীণ কণ্ঠে বলতে পারল আমি মালাইকা আমার
আবেলকে দেখেছ?
এই ঘটনার কয়েকদিন পরে কোসি থেকে
একদল লোক আরযো এসেছিল তারা জানাল পথে একটা সিংহ মরে পরে রয়েছে তার মুখের ভিতরে
সম্ভবত একটা ছুরি।
No comments:
Post a Comment